জাতীয়

যেখান থেকে পাবেন মাত্র ২ টাকায় পেঁয়াজের কেজি

ভারতের মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজের অতিরিক্ত ফলন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সেখানকার কৃষকরা। বাড়তি ফলনের কারণে এ বছর পেঁয়াজের দাম মুখ থুবড়ে পড়েছে। রান্নায় প্রতিদিন ব্যবহার করা পণ্যটির দাম এতোটাই কমে গেছে যে কৃষকরা প্রতি কেজি মাত্র দু-তিন টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন অবস্থায় অনেক কৃষক ক্ষেতেই তাদের ফসল পুড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাধ্য হয়েই কৃষকরা ফসল নষ্ট করে ফেলছেন।

মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার কৃষক কৃষ্ণ ডোংরে। লাভের আশায় এই মৌসুমে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। তবে, লোকসানে ক্ষেতেই অনুষ্ঠান করে পেঁয়াজ পুড়িয়ে দিয়েছেন। এ সময় তাঁর পরিবার সঙ্গে ছিল। এটিকে ‘হোলিকা দহন’ বলা হচ্ছে। সেই পোড়ানো অনুষ্ঠানের ছবিসহ খবর বেশ কিছু জাতীয় সংবাদপত্রে ছাপানো হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছিল সেই পোড়ানোর ছবি।

গত সপ্তাহের শেষের দিকে ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রঙের উৎসব হোলি। তার আগের দিন গত ৬ মার্চ পালিত হয় ‘হোলিকা দহন’। একজন কৃষকের পারিবারিক ‘অনুষ্ঠান’ জাতীয় স্তরের সংবাদপত্রে উঠে আসার কারণ হচ্ছে, তিনি আসলে খড়কুটার বদলে ‘হোলিকা দহন’ করেছেন নিজের ক্ষেতের প্রায় ১৫ হাজার কেজি পেঁয়াজ পুড়িয়ে দিয়ে।

হোলিকা দহন করার ১৫ দিন আগে রক্ত দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠান ডোংরে। চিঠিতে অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই কৃষক বলেন, ‘পেঁয়াজের দামের যা অবস্থা তাতে হয়তো বা আত্মহত্যাই করতে হতো। সেটা করতে পারলাম না, তাই হাতে গড়া ফসলটাই শেষ করে দিলাম।’

ডোংরে পরিবারেরই মতোন অবস্থা মহারাষ্ট্রের আরও হাজার হাজার পেঁয়াজ চাষী পরিবারেও।

পেঁয়াজ চাষী নামদেব ঠাকরে বলেন, ‘ছোট ছেলেটা ১০ টাকা দামের একটা আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল, দিতে পারিনি। ১০ টাকার আইসক্রিম মানে তো পাঁচ কেজি পেঁয়াজের দাম!’

এ বছর মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজের ফলন এত বেশি হয়েছে যে কৃষকরা প্রতি কেজি মাত্র দুই বা তিন টাকা দর পাচ্ছিলেন দুদিন আগে পর্যন্তও। চাষের খরচ তো তাতে উঠছেই না, উল্টো আড়তে পৌঁছে দিতে গেলে তাদের লোকসানের বোঝা আরও বাড়বে। তাই ক্ষেতের পেঁয়াজ নষ্ট করে ফেলছেন কৃষকরা। ডোংরে যেমন পুড়িয়ে ফেলেছেন ক্ষেতের পেঁয়াজ, তেমনই ট্রাক্টর চালিয়ে ফসল নিজেই নষ্ট করে দিয়েছেন নাসিকের নাইপালা গ্রামের কৃষক রাজেন্দ্র বোঢ়গুঢ়ে।

 

এই কৃষক বলেন, ‘তিন একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। পেঁয়াজ মণ্ডিতে আড়ৎদারের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া পর্যন্ত প্রতি একরে এক লাখ দশ হাজার টাকা মতো খরচ হয়েছে। এক একরে ১৫ হাজার কেজি হয়, ভাল ফলন হলে ১৭ থেকে ১৮ হাজার কেজি পর্যন্ত হয়। সেই হিসেবে বর্তমান বাজারে প্রতি একর ফসলের জন্য আমি দাম পাচ্ছি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা, যা আমার খরচের অর্ধেক। তো সেই ফসল আড়ত-এ পৌঁছে দেওয়ার জন্য আরও বাড়তি খরচ করে লোকসানের বোঝা বাড়াবো নাকি আমি?’

ভারতের মহারাষ্ট্রই এক সময় ছিল পেঁয়াজ চাষের মূলকেন্দ্র। কিন্তু বেশ কয়েক বছর যাবত মধ্যপ্রদেশ আর গুজরাটেও পেঁয়াজ চাষ শুরু হয়েছে। এতে মার খাচ্ছেন মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ কৃষকেরা। মহারাষ্ট্রের নাসিকই সবচেয়ে বড় পেঁয়াজ বিপণন কেন্দ্র। সেখানেই পেঁয়াজের আড়ত হীরামন পরদেশির।

হীরামন পরদেশি বলেন, ‘আগে শুধু মহারাষ্ট্র আর অন্ধ্র প্রদেশেই পেঁয়াজের মূল চাষটা হতো। কিন্তু, এখন মধ্যপ্রদেশ আর গুজরাটের চাষিরাও ভালো পেঁয়াজ চাষ করছেন। গুজরাটে তো পেঁয়াজ চাষীদের জন্য সেখানকার সরকার অনুদানও দিয়েছে এবার। আর আমাদের পেঁয়াজের যে বাজার ছিল, সেটা গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ধরে নিয়েছে অনেকটা। তাই এখানকার কৃষকরা মার খাচ্ছে।’

হীরামন পরদেশি আরও বলেন, ‘আমাদের পেঁয়াজ উত্তর আর পূর্ব ভারতে চালান হত বড় পরিমাণে। কিন্তু গুজরাট আর মধ্যপ্রদেশ থেকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পেঁয়াজ পরিবহণের খরচ অনেকটাই কম লাগে দূরত্বের কারণে। তাই আমাদের থেকে কম দামে ওখানকার চাষিরা পেঁয়াজ সরবরাহ করতে পারছে।’

হীরামন পরদেশি আরও বলেন, ‘আগে পাকিস্তানে যেত আমাদের পেঁয়াজ। শ্রীলঙ্কাতেও রপ্তানি হতো। কিন্তু, ওই দুটো দেশের যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সেখানে আর পেঁয়াজ পাঠানোর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা। আবার বাংলাদেশেও ভারতীয় পেঁয়াজের রপ্তানিও কমে গেছে।’

এদিকে, কৃষকদের কাছ থেকে পেঁয়াজ কেনার ঘোষণা দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনাবিশ। আবার কৃষকদের অনুদান দেওয়ার কথাও হয়তো ঘোষণা করবে বলে কোনো কোনো সূত্র জানাচ্ছে। আর কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় কৃষি সমবায় বিপণন ফেডারেশন (ন্যাফেড) দিয়ে সরকার পেঁয়াজ কিনতে শুরু করেছে।

নাসিকের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হীরামন বলছিলেন, ‘ন্যাফেড বাজারে নামার পরে সামান্য বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। এখন প্রতি ১০০ কেজির জন্য প্রায় সাতশ টাকা পাচ্ছেন কৃষকরা। কিন্তু, ন্যাফেড তো সীমিত পরিমাণে পেঁয়াজ কিনছে। বাকি এই বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজের কী হবে?’

কৃষক বোঢ়গুঢ়ে বলেন, ‘শুনছি তো ন্যাফেড নাকি পেঁয়াজ কিনছে। কিন্তু, কোথায় তারা। আমরা তো দেখতে পাচ্ছি না। আর ন্যাফেড তো নিজে কেনে না, বিভিন্ন এজেন্সিকে দিয়ে পেঁয়াজ কেনায়।’

কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট দেবেন্দ্র শর্মা বলেন, ‘এবছর শুধু যে মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষিরা ফসলের দাম না পাওয়ায় তা নষ্ট করে দিচ্ছেন তা নয়। প্রায় সব রাজ্যেই কৃষকরা ফসল নষ্ট করে দিচ্ছেন দাম না পাওয়ার কারণে। পাঞ্জাব থেকে পশ্চিমবঙ্গ– এই বিরাট অঞ্চলের আলু চাষিদের অবস্থা দেখুন, তারাও দাম না পেয়ে রাস্তায় আলু ফেলে দিচ্ছেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *